ভ্রমণ প্রেমী বা পর্যটকদের জন্যে অসাধারন এক গন্তব্য হতে পারে এই নিঝুম দ্বিপ। একদিকে মেঘনা নদী, আর তিন দিকে বঙ্গপসাগর যেন কড়া পাহারায় রেখেছে সৌন্দর্যের এই ছোট্ট লীলাভূমিকে। এটি নোয়াখালী জেলায় অবস্থিত। আয়তন মাত্র ৯১ বর্গ কিলোমিটার। দিনে ২ বার জোয়ার-ভাঁটার পানি যেন পরিষ্কার করে দিয়ে যায় ছোট্ট কিশোরীর পা। ছোট্ট হলে কি হবে? রয়েছে মাইলের পর মাইল কেওড়া বন। আর রয়েছে চিত্রা হরিণ, সরকারী হিসাবে প্রায় ৪০ হাজার। সুতরাং চিত্রা হরিণ দেখার সুযোগ মিস করার কোন সুযোগ এখানে নেই।
১৯৫০ সালের দিকে এই দ্বীপ জেগে ওঠে। একে দ্বীপ বলা হলেও এটি মুলত কিছু চড় এর সমষ্টি। এর প্রাচীন নাম ইছামতী। এখানে প্রচুর চিংড়ি মাছ পাওয়া যেত, চিংড়িকে এখানে ইচা মাছ বা ইছা মাছ বলা হয়। তাই জেলেদের নামকরণে এর নাম হয়ে যায় ইছামতী। এই দ্বীপে প্রচুর ঘাস জন্মাতে থাকে, ঘাসকে আঞ্চলিক ভাষায় উরি বলে। এর কারণে ধিরে ধিরে মহিষ পালকেরা এখানে বসবাস করে। মহিষ পালকদের বলা হয় বাথান। ১৯৫৭ সালে বাথানদের সর্দার ওসমান বাথাইন্না এখানে আসেন। বাথানরা একে নাম দিয়েছিল বাউলা চড় বা বেলা চড় বা বালু চড়। ১৯৫৯-৬০ সালের দিকে এখানে সরকারী ভুমি জরিপ হয়। ভুমি জরিপে সহায়তা করায় বাথাইন্না সর্দার ওসমান এর নামকরনে এর নাম হয় "চড়-ওসমান"। ১৯৭০ এর আগে মানুষজনের মৌসুমি বসবাস হলেও বছরের বেশির ভাগ সময়ই থাকত জনবিরল। একারণেই হয়ত কাব্যিক নামকরনে এর নাম হয়েছে "নিঝুম দ্বীপ।"
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বন বিভাগ নিঝুম দ্বীপে উপকূলীয় বনাঞ্চল কার্যক্রম শুরু করে। এর অংশ হিসেবে প্রায় ২ কোটি ৪৩লাখ গাছের চারা লাগানো হয়েছে। এটি কৃত্রিম ম্যানগ্রোভ বন; এখানে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের মধ্যে রয়েছে কেওড়া, গেওয়া, কাঁকড়া, বাইন প্রভৃতি। বন্য পরিবেশে রয়েছে চিত্রা হরিণ, বন মহিষ, সাপ, উদ বিড়াল প্রভিতি বন্য পশু। এছাড়াও এখানে দেখা যায় প্রায় ৩৫ প্রজাতির পাখি।
প্রায় ১২ হাজার মানুষ এখানে বাস করে, তাদের পেশা প্রধানত মাছ ধরা, কৃষিকাজ এবং পশুপালন। হাতিয়া, ভোলা কিংবা ঢাকার সাথে যোগাযোগ করতে হলে তাদের পুরোপুরি জোয়ারভাটা মেনে চলতে হয়। ঢাকায় যেতে হলে তাদেরকে সকাল ৯ টার (জোয়ার আসার)পর হাতিয়ার উদ্দেশ্য যাত্রা করতে হয়। প্রায় ২-৩ ঘণ্টা সময় পর ট্রলার হাতিয়া পৌঁছায়। অতঃপর পাওয়া যায় ঢাকাগামী লঞ্চ, যেটি প্রতিদিন একবেলা ঢাকার উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা করে। এই লঞ্চটি বরিশাল এবং ভোলা হয়ে ঢাকায় পৌঁছায় বিধায় নিঝুম দ্বীপের মানুষজন ভোলা কিংবা বরিশালে যেতে পারেন এই লঞ্চে করেই। এছাড়া হাতিয়া কিংবা ঢাকায় আসার জন্য রয়েছে বিকল্প পথ। বন্দরটিলা থেকে নদী পার হয়ে হাতিয়ায় পৌঁছতে হয়। সেখান থেকে বিভিন্ন যানবাহন পার করে প্রথমে হাতিয়া শহরে তারপর লঞ্চে পার হয়ে মাইজদি অতঃপর ঢাকায় পৌঁছতে হয়।
নিঝুম দ্বীপে পর্যটকদের জন্য রয়েছে অবকাশের নিঝুম রির্সোট। যেখানে রয়েছে সাপ্লাই পানি এবং জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থা। খাবারের জন্য রয়েছে স্থানীয় হোটেল। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত চাল, মাছ, মুরগী, ডিম ইত্যাদিই খাবারের একমাত্র ভরসা। তবে বর্ষার মৌসুমে রয়েছে ইলিশের জয়জয়কার। পর্যটকদের জন্যে এখানে একটি উপভোগ্য বিষয় হলো রাতের ক্যাম্প ফায়ার আর বারবি-কিউ। বিখ্যাত কোন হোটেলের বারবি-কিউ নয়, স্থানীয় ভাবে তৈরি। আর একটি ভিন্ন রকমের বারবি-কিউ পাওয়া যায়। তা হলো ইলিশ বারবি-কিউ। ইলিশ বারবি-কিউ, পরোটা আর খোলা আকাশের নিচে গলা ভরা গান যেন এক মায়াচ্ছন্ন মুহুর্তের সৃষ্টি করবে।
No comments:
Post a Comment